খুশকি দূর করার উপায়। চিকিৎসা, ঔষধ-শ্যাম্পু
চুলের খুশকি অন্যতম বিরক্তিকর একটি বড় সমস্যা। মাথায় খুশকি হলে চুলকানি এবং চুল ঝরে পড়ে যাওয়ার মতো সম্ভাবনা রয়েছে। তাই আজকে আমরা জানবো প্রাকৃতিক নিয়মে খুশকি দূর করার উপায়। মাথার ত্বকে অতিরিক্ত ফাঙ্গাস হওয়ার কারণে খুশকির সমস্যা হয়ে থাকে। প্রাকৃতিক নিয়ম অনুসারে আমাদের মাথার ত্বক বা স্কাল্পে কিছু নতুন কোষ উৎপন্ন হয় এবং পুরানো পোস্ট গুলো ঝরে পড়ে।
এই প্রক্রিয়াটি একটি সাধারন চক্র হিসাবে চলতে থাকে। এই পুরানো মৃতকোষগুলো যখন মাথার ত্বকের সাথে মিলে যায় এবং সাদা আঁশের মতো অস্বস্তি প্রকাশ করে। আমরা তখন এটাকে খুশকি বলি। খুশকি দীর্ঘদিন মাথা থাকলে প্রচন্ড চুলকানি হয় এবং এর থেকে চুল পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এবং মাথায় ক্ষতস্থান সৃষ্টি হতে পারে। তাই আমাদের উচিত যথাসম্ভব খুশকি দূর করার উপায় এবং চিকিৎসা ও ওষুধ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে হবে।
মাথায় খুশকি হওয়ার কারণ কি
অনেকের কাছে খুশকি দুশ্চিন্তা কারণ হলে এটি কোনো রোগ নয় বা রোগের লক্ষণ না। মাথার ত্বকে পুরানো মৃতকোষ জমে এবং ছত্রাকের প্রভাবে খুশি হয়ে থাকে। এছাড়া মাথায় খুশকি হওয়ার আর বেশ কিছু কারণ রয়েছে।
ত্বক রুক্ষ- শুষ্ক
শীতের আবাহাওয়া আদ্রতা কমে যাওয়ার কারণে দেহের ত্বকের পাশাপাশি মাথার ত্বক ও রুক্ষ শুষ্ক হয়ে যায়। সেজন্য শীতের সময়ে মাথার খুশকি অনেক বেড়ে যায়। তাছাড়া শীতের সময় বাইরের ঠান্ডা বাতাস এবং ঘরে তুলনামূলক গরম বাতাস এর ফলে তাপমাত্রা যে সামঞ্জস্যহীনতা দেখা যায় সেটি খুশকি হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
অতিরিক্ত তেল ব্যবহার
একটি গবেষণায় দেখা গেছে যারা মাথায় অতিরিক্ত তেল ব্যবহার করে থাকেন তাদের পুষ্টি সংক্রমণের ঝুঁকি অন্যদের তুলনায় অনেকটা বেশি। মাথায় অতিরিক্ত তেল ব্যবহার করার কারণে তেল স্তপ আকারে চুলের গোড়ায় জমা হয় পরবর্তীতে সেখানে তাকে প্রাদুর্ভাব ঘটে। যার ফলে মাতার পুষ্টির পরিমাণ বৃদ্ধি পায়।
চুল না আঁচরানো
আমরা অনেকেই নিয়মিত চুল আঁচরায় না। যদি নিয়মিত চুল আচঁড়ানো না হয় তাহলে মাথার ত্বকের মৃতকোষ একসাথে জড়ো হয়ে যায়। ফলে সেগুলো জরে না পরে বরং চুলের গোড়ায় জমা হতে থাকে। যার ফলে খুশকি তৈরি হয়। চুলে পর্যাপ্ত পরিমাণ সেম্পু না করলে চুলের গোড়ায় অপরিষ্কার থাকে যার ফলে খুশকি উৎপন্ন হয়।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া
দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেলে খুশকি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। বিশেষ কিছু রোগ যেমন পারকিনসন ডিজিজ, হৃদ রোগ, স্ট্রোক সেস্নিটিভ ত্বক এবং ত্বকের সমস্যা, সোরিয়াসিস, একজিমা ইত্যাদি যাদের রয়েছে তাদের খুশকি হওয়ার প্রবণতা অনেক বেশি লক্ষ্য করা যায়।
এক গবেষণায় পাওয়া যায় 10.6% মানুষ যাদের এইচআইভি আছে তাদের খুশকি সমস্যার বেশি থাকে। তাছাড়া খাদ্যভাসের অনিয়মের কারণে খুশকি হয়ে থাকে। আপনার খাবারে পর্যাপ্ত পরিমাণ ভিটামিন বি এবং জিংক না থাকলে খুশকি হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়। এছাড়া অধিক পরিমাণ চর্বি জাতীয় খাদ্য গ্রহণ করলে খুশকি হতে পারে।
অন্যান্য কারণ
অতিরিক্ত মানসিক চাপ খুশকি হওয়ার একটি অন্যতম কারণ। অনেক সময় পানির সমস্যার কারণে খুশকি হতে পারে। বেশি পরিমাণ ক্লোরিনের আছে এমন পানি দিয়ে গোসল করলে তাড়াতাড়ি শুষ্ক হয়ে যায়। যা মাথার খুশকির কারণ হয়ে উঠতে পারে। আমাদের সকলের ত্বকে ম্যালেসেজিয়া নামে এক ধরনের পাঙ্গাস পরিমাণমতো থাকে এবং এটি তেমন কোনো সমস্যা সৃষ্টি হয় না। তবে এই ফাঙ্গাসের পরিমাণ অতিরিক্ত হারে বৃদ্ধি পেলে তা ত্বকের ক্ষরিত তৈল শোষণ করে নেই। যার ফলেই স্ক্যাল্প অতিরিক্ত ত্বকীয় কোষ উৎপাদন করে থাকে। ঐ সকল অতিরিক্ত কোষ মৃত হলে স্ক্যাল্প ও চুলের তেলের সাথে মিশিয়ে খুশকির সৃষ্টি করে থাকে।
>আরও পড়ুন- কিচমিচ এর উপকারিতা ও গুনাগুন বিস্তারিত
খুশকি দূর করার উপায়
খুশকি দূর করার অনেকগুলো উপায় থাকলেও কিছু প্রাকৃতিক নিয়ম অনুসরণ করে আপনি কার্যকরী ফলাফল পেতে পারেন। যার ফলে আপনার কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন হতে হবে না।
নারিকেল তেল: একাধিক স্বাস্থ্যসুবিধা জন্য সুপরিচিত নারকেল তেল খুশকির জন্য অনেক ভালো একটি প্রাকৃতিক উপাদান হিসাবে ব্যবহৃত হয়। নারকেল তেল ত্বকের হাইড্রেশন উন্নত করতে এবং শুষ্কতা রোধে সহায়তা করতে পারে যা খুশকি দূর করতে সাহয্য করতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল লাইব্রেরী অফ মেডিসিন এর একটি গবেষণায় দেখা গেছে নারকেল তেল হাইড্রেশন উন্নত করতে উনিশশত কার্যকর ভূমিকা রাখে। আরো অন্যান্য গবেষণায় দেখা যায় নাকের তালে একজিমা চিকিৎসা সহায়তা করে। এটি ত্বকের খুশকি দমনে অবদান রাখে।
ডিম: ডিম চুলের খুশকি দূর করতে কার্যকরী ভূমিকা রাখে। একটি ডিমের সাদা অংশ 4 টেবিল চামচ টক দই খুব ভালোভাবে মিশ্রন করে নিন। এরপর এক টেবিল চামচ লেবুর রস মেশান তারপর মিশ্রণটি মাথার ত্বক সহ পুরা চুলে লাগান। 20 মিনিট পর চুল শ্যাম্পু দিয়ে ধুয়ে ফেলুন সপ্তাহে অন্তত একবার ব্যবহার করুন।
মানসিক চাপ: মানসিক চাপ স্বাস্থ্য এবং সুস্থতাকে নেতিবাচকভাবে প্রবাহিত করে। এটি কামান্নায়ে দীর্ঘস্থায়ী বলে মানসিক স্বাস্থ্য বিপর্যয় সম্ভাবনা থাকে। খুশকি উৎপান্নর ক্ষেত্রে মানসিক চাপ বা স্ট্রেসের প্রত্যক্ষ ভুমিকা নেই। তবে এটি শুষ্কতা এবং চুলকানির মত লক্ষণগুলো বাড়িয়ে তুলতে পারে। যা পরবর্তীতে খুশকি আকারে দেখা দেয়।
দীর্ঘমেয়াদি বা উচ্চপর্যায়ের স্ট্রেস ব্যক্তির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল করে দেয়। যার ফলে আপনার শরীরে কিছুটা ছত্রাকের সংক্রমণ হ্রাস পায় এবং ত্বকের অবস্থা সাথে লড়াই ক্ষমতা হ্রাস পায় যা পরে খুশকি তৈরি করতে পারেন। যার কারণে মানসিক চাপের সঙ্গে পুষ্টি অন্যতম একটি স্বাম্ভাব্য কারণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
পেঁয়াজের রস: পেঁয়াজের রস খুশকি দূর করতে পারে। পেঁয়াজ ছোট করে ভেটে নিয়ে ছেঁকে রস বাহির করতে হবে। পেঁয়াজের রস চুলের গোড়ায় ভালো করে এবং ঘষে ঘষে লাগাতে হবে। 20 থেকে 25 মিনিট পর একটু ভালো করে চুল শ্যাম্পু দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে। সপ্তাহে অন্তত দুইবার চুলে পেঁয়াজের রস লাগালে মাথা চুলকানো ও খুশকি কমে যাবে।
চা গাছের তৈল ব্যবহার: চা গাছের শক্তিশালী অ্যান্টি- মাইক্রোবিয়াল এবং অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। যা খুশকির লক্ষণগুলো হ্রাস করতে সহায়তা করে। চা গাছের তৈল ছত্রাকের নির্দিষ্ট স্টেনের বিরুদ্ধে লড়াই করতে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। একটি গবেষণায় পরীক্ষায় দেখা যায় 4 সাপ্তাহে চা গাছের তৈল 126 জনের মাথায় প্রয়োগ করে দেখা হয়েছে। যার প্রভাব লক্ষ্য করে দেখা যায় চা গাছের তৈল খুশকির লক্ষণগুলোর তীব্রতাকে 41% হ্রাস করে এবং চুলকানি কমিয়ে দেয়।
মেথি: মেথি চুলের জন্য একটি উপকারী প্রাকৃতিক উপাদান। চ্যালেঞ্জ নারিকেলের ঘরম তেলের সাথে মেথি গুঁড়া মিশিয়ে নিতে হবে। সেই মিশ্রণটি চুলে লাগিয়ে এক ঘণ্টা পর শ্যাম্পু দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। সপ্তাহে তিন দিনে ব্যবহার করুন ভালো ফলাফল পাওয়া জন্য। আর একটি মাধ্যম আছে কেমন সারা রাত ভিজিয়ে রেখে একটি সকালবেলা থেঁতো করে চুলের গোড়ায় লাগান। 30 মিনিট পর চুল ধুয়ে ফেলুন। সপ্তাহে অন্তত দুই ধারে এটি ব্যবহার করুন।
অ্যালোভেরা ব্যবহার: ত্বকের জন্য বহু প্রাচীনকাল থেকে অ্যালোভেরা ব্যবহার করে আসছে। অ্যালোভেরা এমন একটি প্রাকৃতিক উপাদান যা আপনার ত্বকে রুক্ষ-শুষ্ক করতে সর্বোচ্চ সাহায্য করে।। এটি পোড়া ঘা এবং সোরিয়াসিসের মতো সমস্যায় সফল ভাবে কাজ করে।
ম্যালেসেজিয়া নামের এক ধরনের ফাঙ্গাস আমাদের মাথায় খুশকির উদ্ভব ঘটায়। অ্যালোভেরা ঐ সকল এন্টিবায়োটিরিয়াল এবং অ্যান্টিফাঙ্গাস বৈশিষ্ট্যগুলো খুশকি থেকে রক্ষা করতে পারে। একইভাবে একটি টেষ্ট টিউব সমীক্ষায় দেখা গেছে অ্যালোভেরা বেশ কিছু প্রজাতির ফাঙ্গাসের বিরুদ্ধে কার্যকর ভূমিকা রাখে। অ্যালোভেরা মাথার ত্বকে চুলকানির কারণ ছত্রাকের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রনে সহায়তা করতে পারে।
অলিভ অয়েল: চুলের স্বাস্থ্য রক্ষাতে এবং খুশকি দূর করতে অলিভ অয়েল এর কোনো জুড়ি নেই। প্রথমে অলিভ অয়েল গরম করে পাতি লেবুর রস মিশিয়ে চুলের গোড়া সহ পুরা চুলে লাগিয়ে এক ঘণ্টা অপেক্ষা করুন। তারপর চুল ভালো করে শ্যাম্পু দিয়ে ধুয়ে নিন। সপ্তাহে দুই থেকে তিনবার অলিভ অয়েল লাগান। এতে করে খুশকি হওয়ার পাশাপাশি চুল হবে কোমল এবং জলমলে।
খুশকি দূর করার আরও কিছু উপায়
- যাদের চুলে প্রায় খুশকি হয়ে থাকে তারা নিয়মিত চুলের পরিমিত শ্যাম্পু ব্যবহার করতে পারেন।
- মেয়েদের ক্ষেত্রে বাইরে বের হলে ধুলাবালি থেকে রক্ষার জন্য মাথায় স্কার্ফ বা ওড়ানা ব্যবহার করা যেতে পারে।
- চুল অপরিষ্কার থাকলে খুশকি বেশি হয়। তাই নিমিতপুরী চুল পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার চেষ্টা করবেন।
- গোসল করার পর যত দ্রুত সম্ভব চুল খুব ভালো করে মুছে নিবেন। তবে চুল শুকানোর জন্য হেয়ার ড্রায়ার ব্যবহার না করে ফ্যানের বাতাসে শুকিয়ে নেওয়া ভালো।
- চুলে খুশকি নিয়ন্ত্রণে খাদ্যাভাসের পরিবর্তন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সেজন্য মাথার ত্বক ভালো রাখতে প্রচুর পরিমাণ শাকসবজি খাওয়া এবং অতিরিক্ত চর্বি জাতীয় খাদ্য বর্জন করা।
খুশকি দূর করার শ্যাম্পু
আপনি কি জানেন শ্যাম্পু শুধুমাত্র তেল অপসারণ করে না মাথার ত্বক পরিষ্কার করতে, খুশকি দূর করতে, ছত্রাকের সংক্রমনের বিরুদ্ধে লড়াই করতে এবং চুলকানি কমাতে সাহায্য করে। সপ্তাহে দুই থেকে তিন দিন শ্যাম্পু ব্যবহার করে মাথার ত্বক পরিষ্কার রাখা উচিত। এতে করে চুলের বৃদ্ধি ঘটে এবং মাথার ত্বকের স্বাস্থ্য স্বাভাবিক থাকে। শ্যাম্পু চুলের পরিচর্যার জন্য অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এই সাধারন জিনিসটার অনেক তেমনটা গুরুত্ব দেয় না। অনেকের ধারণা শুধুমাত্র তেল এবং ময়লা দূর করার জন্য শ্যাম্পু ব্যবহার করা হয়। এবং মনে করে এটি শ্যাম্পু মল্লিক দায়িত্ব। আসলে কি তাই?
আপনি কি জানেন শ্যাম্পু শুধুমাত্র তেল অপসারণ করে না। মাথার ত্বক পরিষ্কার করতে, খুশকি দূর করতে, ছত্রাকের সংক্রমনের বিরুদ্ধে লড়াই করতে এবং চুলকানি কমাতে সাহায্য করে। শুষ্ক তেল, তৈলাক্ত চুলের সঙ্গে শুষ্ক মাথার ত্বকে সঙ্গে তৈলাক্ত মাথার ত্বকের সঙ্গে লড়াই করে। বাজারে বিভিন্ন ব্যান্ডের শ্যাম্পু কেনার আগে যে উপাদান গুলো দিকে বিশেষ নজর দিবেন তা হল: টি ট্রি অয়েল, রসুন, মেথি বীজ, পেঁয়াজের রস, কারি পাতা, ক্যাস্টর অয়েল, আমলা ইত্যাদি এসব উপাদান গুলো থাকলে তাহলে আপনি সেই শ্যাম্পু গুলো ব্যবহার করবেন।
খুশকি দূর করার হোমিও ঔষধ
শেষকথা
নিয়মিত চুল আঁচড়ানো এতে খুশকি হবার সম্ভাবনা কমে যাবে। পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করুন। এতে মাথার ত্বক এবং চুল ভালো থাকবে। নিয়মিত চুল পরিষ্কার রাখুন কারণ চুলা অপরিষ্কার থাকলে খুশকি বেশি হয়। কিছু চর্মরোগ সাধারণভাবে দেখতে খুশকির মত হয়। তাই মাথায় খুশকির পরিমাণ বেশি হলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন। আশা করি এই পোষ্টের মাধ্যমে আপনি খুশকি দূর করার উপায় জানতে পেরেছেন।
>আরও পড়ুন- টেস্টোস্টেরন হরমোন বৃদ্ধির উপায়। পরীক্ষা, চিকিৎসা এবং ওষুধ